Monday, October 10, 2016

Selected Poems of Anna Akhmatava

আনা আখমাতোভা 

কবি পরিচিতি 
রাশিয়ায় ৮০ দশকের শেষ দিকে পেরেস্ত্রোইকা শুরু হবার পরে আন্না আখমাতভা নতুন করে আবিস্কৃত হন।
তাকে ছাই চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল লৌহ যবনিকার কালে। সারা জীবনে এত বেশী অশ্রুপাত করতে হয়েছে যে যে কোন মরা নদী ফুলে ফেপে উঠবে। আমার একটি লেখায় আছে:
"নেভা , তুমি এত জল কোথায় পেলে?"
নেভা নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল ," আন্না আখমাতভার চোখ থেকে।"
মহাদেবের জটা থেকে গঙা নেমে আসে  জানি, কিন্তু কোন নারীর চোখ থেকে নদীর জন্ম হয় এই আমি প্রথম জানলাম।

১৮৮৯ সালে ওডেসার কাছে জন্ম (বর্তমান ইউক্রেন) , মৃত্যু ১৯৬৬ সালে মস্কোতে।আসল নাম আন্না আন্দ্রেয়েভনা গরেন্কো।

১৯২১ সালে তার প্রথম স্বামী নিকোলাই গুমিলেওভকে হত্যা করা হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে, তার ছেলে লেভ গুমিলেওভ এবং স্বামী নিকোলাই পুনিন বহু বছর গুলাগে কাটান। পুনিনকে ১৯৫৩ সালে হত্যা করা হয়। ছেলে গুলাগ থেকে মুক্ত হন ১৯৫৫ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে। তার স্বল্প কালীন প্রেমিক ও বন্ধু ওসিপ মেন্ডেলস্টামকে হত্যা করা হয় ১৯৩৮ সালে।

সারা জীবন কাটে ক্ষমতার সর্বদৃষ্ট চোখের সামনে, তার ঘরের প্রতিটি কথা শোনা ও রেকর্ড করা হতো, তাকে জানলায় দাঁড়িয়ে  বাইরে অপেক্ষারত  অফিসারকে প্রতিদিন হাজিরা দিয়ে দেখাতে হোত যে তিনি আত্মহত্যা করেননি। তার লেখার প্রকাশনা বন্ধ করা হয়ে ছিল । তিনি যা লিখতেন তা তার বান্ধবী নি:শব্দে পড়ে মুখস্ত করে ফেলার পরে কাগজ পুড়িয়ে ফেলা হত। পরে তার বান্ধবী অন্যত্র লিখে সেগুলো সংরক্ষণ করতো। এভাবেই লেখা হয় তার বিখ্যাত "রেকুইয়েম" এবং অন্যান্য অনেক কবিতা।

মোহাম্মদ জামানের তিন কবির অপূর্ব অনুবাদই ইংরেজী থেকে, আন্না আখমাতভার কবিতার অনুবাদ মূল লেখার খুব কাছাকাছি। তার পরিশ্রম সফল। বাংলা সাহিত্য তার এই অনবদ্য সংযোজনের দ্বারা শুধু সমৃদ্ধই হয়নি , বরং বাংগালী পাঠক সুযোগ পেয়েছে বিশ্বসাহিত্যের তিনজন দ্রোহী কবির সাথে পরিচিত হবার।

শাহাব আহমদ
ওকালা , ফ্লোরিডা
নভেম্বর ২০১৬


অনুবাদকের কথা 
আখমাতোভা বিংশ শতকের সোভিয়েত নির্যাতন ও গুলাগ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড চিৎকার:
নিঃশব্দে বহে নদী ডন


আকাশে হলুদ চাঁদ চেয়ে আছে

নিঃশব্দ রোদন

মূল কবিতার ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত।
খামতি অবশ্যই আছে।

মোহাম্মদ জামান
নিউ ইয়র্ক, নভেম্বর ২০১৬






উইলো (Willow)
শতাব্দী তখনো শিশু - তার পাঠশালায় নিরন্তর নিরীক্ষা
নিয়ন্ত্রিত প্রশান্তি - তার ভিতরেই  আমার বেড়ে উঠা
আমি ভীত - মানুষ্য-কণ্ঠ আমাকে আনন্দিত করে না
হাওয়ার বার্তা শুনি - আমি বুঝি হাওয়াদের কথা

আর সবচেয়ে ভালো ছিলো সেই রূপালী উইলো বৃক্ষ
আনত বৃক্ষ - সে ছিলো পাশে
জীবন-ভর আমার জীবন ভরে
তার ক্রন্দসী শাঁখা স্বপ্নে ভোরে দিতো
আমার বিনিদ্র রাত্রিগুলো

আশ্চর্য্য
আমি এখনো বেঁচে - বেঁচে নেই স্বপ্ন-দায়িনী সেই উইলো
তার গোড়া থেকে উত্থিত হয় আশ্চর্য্য কথা
অন্যান্য উইলোরা দূর থেকে কথা বলে

উপরে নির্নিশেষ গগন
নিচে একাকী ও স্তব্ধ - যেন আমারি ভ্রাতার
প্রয়াণ

বোরিস পাস্তারনাক (Boris Pasternak)
অতুলনীয় সেই একলা কণ্ঠ - আজ স্তব্ধ
ফল বাগানের সেই সাথী - আর নেই
সে আজ অনন্ত শ্রুতি - বৃষ্টিতে ভাত
পুনর্বার সেই সংগীত

স্বর্গের অবতলে ফুটে আছে যে সব পারিজাত
তারাও জেগে উঠেছে মৃত্যুর সান্নিধ্যে
অথচ অনন্ত নীরবতা যখন এলো
ভারাক্রান্ত
আহা

এই গ্রহ
অভিধানে যার বিনীত নাম
পৃথিবী

লাস্ট টোস্ট (The Last Toast)
পান করি নষ্ট মাতৃভূমির প্রতি
পান করি আমার নষ্ট জীবনের প্রতি
আমাদের দ্বৈত একাকিত্বের প্রতি
এবং তোমার অনাগত দিনগুলির প্রতি
ভালো ...

বিশ্বাস-হন্তা সেই ওষ্ঠের প্রতি
মৃত্যু-শীতল সেই চোখের প্রতি
নষ্ট পৃথিবী - তার নষ্টামীর প্রতি
এবং সেই নষ্ট ঈশ্বরের প্রতি

যিনি রক্ষা-কর্তা
অথচ রক্ষার বিহিত নেই

শেষ দেখার সংগীত (Song of the Final Meeting)
আমার বুক ঠাণ্ডা হয়ে আসলো
দুলে উঠলো পা
বাম হাতের মোজা ভুল করে পড়লাম ডানে
সিঁড়ির ধাপ যেনো অনন্তে উঠে গেছে
অথচ জানি আর মোটে তিন ধাপ বাকী

ম্যাপল বনের থেকে
হেমন্তের অপরাহ্ন হাওয়া
ফিসফিসিয়ে বলে গেলো :
"চলো আমার সাথে - মৃত্যু ডাকে"

মন্দ প্রেত আমাকে বিপথে নিয়ে গেছে
নিয়তি - অন্ধকার ও অপার্থিব
আমি উত্তর দিলাম:
"হে প্রিয়, আমিও
আমিও যাবো তোমারই সঙ্গে
ওপারে"

এই আমাদের শেষ সাক্ষাতের সংগীত
আমি ঘরের অন্ধকার কাঠামোটা ক্ষণিক দেখে নিলাম
শুধু শোবার ধরে একজন মোমবাতি জ্বলছে
তা'র হলুদ শিখা নির্নিমেষ

সহজ জীবন কোথাও না কোথা আছে (Somewhere There is a Simple Life)
কোথাও না কোথা নিশ্চিত আছে সহজ এক জীবন ও এক সহজতর ভুবন
অচ্ছদ উষ্ণ ও আনন্দিত
সেখানে অপরাহ্ন মুখরিত হয়
বালক ও তার প্রতিবেশী বালিকার অকারণ কথার ঝলকে
এবং একমাত্র মক্ষিকারাই শুনতে পায় সেইসব সংবেদন
ও প্রাণের মর্মর

কিন্তু আমাদের যাপিত জীবন নিতান্তই ক্রান্তি-ময় ও পোশাকী
আমাদের মেনে নিতে হয় পরিচয়ের ঐসব তিক্ত ও অসার আচার
উদ্যত হাওয়া যখন সহসা আসে - ভেঙে দেয় আচার-আগল
খুলে আসে কথার নতুন বুনন
শুরু হয় কথা
কথোপকথন -

কিন্তু আমরা কি কোন কিছুর বিনিময়ে রাজি হবো
ত্যাগ করতে এই পাথর নির্মিত দুর্গ-নগরী
দুর্গতি ও গৌরব
বরফাচ্ছাদিত মসৃন ও প্রশস্ত নদনদী
সূর্য্য-বিহীন বিষন্ন বাগান
এবং সংগীতের বিশীর্ণ ধারা

আমি ফুল ভালোবাসি না (I Don't Like Flowers)
আমি ফুল ভালোবাসি না - ফুল স্বরণে আনে
শ্বশান-যাত্রার, ফুল শয্যার ও বল-নৃত্যের কথা
খাবার টেবিলে ফুলের সমাহার দেখলে মনে আসে
নৈশ ভোজ

কিন্তু প্রায়-চিরন্তন সেই সব গোলাপের চির-সাধারণ মুগ্ধতা
বাল্য বয়সে যা ছিলো আমার প্রধান আনন্দ
সে এখনো আছে - সে আমার ঐতিহ্য - সে আমার বিগত বৎসর
সে যেন মোজার্ট এর চির-জাগরুক সুরের সুরধুনী

আকাশের চাঁদ যদি (If the Moon on the Skies)
আকাশের চাঁদ যদি ভুলে যায় তার পরিক্রমণ
ও স্থানু হয় হিমে জমে যাওয়া মোহরের মতো উপরে
আমার মৃত স্বামী ভালোবাসার চিঠিগুলো পড়ার জন্যে
ফিরে আসে ঘরে

ওক কাঠের চিঠির বাক্সের কথা মনে আছে তার
অতি গোপন ও কিমভুত তালার কথাও
ঘরের মেঝেতে সে এঁকে যায় তার পদচিহ্ন
লৌহ কপাটের মতোই অলঙ্ঘনীয় সে চিহ্ন

সাক্ষাতের সময় পঞ্জিকা সে দেখে নেয়
এবং ঝাঁপসা হয়ে আসা টিপ্ সহির দলিল।
পর্যাপ্ত শোক কি এখনো জোটেনি ওর
এবার কতটুকু দুঃখ - আর কত ?

ও ভালোবেসেছিলো (He Did Love)
ত্রিভুবনে ওর তিনটি ছিলো ভালোবাসা:
গির্জার সান্ধ্য স্যামসংগীত, শুভ্র ময়ূরী
এবং ক্ষয়ে যাওয়া মোচড়ানো মানচিত্র

ও ভালোবাসতো না শিশুর কান্না
রাস্পবেরী-সমেত পরিবেশিত চা
এবং ছিটগ্রস্ত নারী

আর আমি ছিলাম তাহার স্ত্রী

ক্রুশবিদ্ধ (Crucifix)
(I)
দেবশিশুর সমবেত সংগীতে
আর আগুন-গলা আকাশ-আবিরে
ও বজ্র-গর্জনে পূত পবিত্র হলো
সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ

পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি:
"পিতঃ - কি কারণে পরিত্যক্ত আমি --- "
আর মাতাকে বললেন:
"মাতঃ - কেঁদো না"
(II)
মাগদালেনা ভারাক্রান্ত, ফুঁপিয়ে কাঁদলেন ও আক্ষেপ করলেন
পাথরের নিথর স্তব্ধতায় নিমজ্জত পিটার ...
কিন্তু যেই একটেরে কোনে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল একাকী মাতা
কেউ চেয়ে দেখলো না - চেয়ে দেখার সাহসও দেখালো না

প্রস্থান (Departure)
যদিও এই দেশ আমার নিজস্ব না,
মনে পড়বে এ দেশের অন্তর্লীন সমুদ্র
এবং তার অতীব শীতল জল
প্রাচীন অস্থির মতো শুভ্র বালি
এবং বেলাশেষের অস্তরাগে
পাইন বৃক্ষের সেই অদ্ভুত লালিমা

আমি বলতে পারছি না:
এটাই কি আমাদের ভালোবাসা
না দিবসের ঘনিয়ে আসা অন্তিম

মানুষ যখন পরস্পর সন্নিহিত (In Human Closeness There)
মানুষের পরস্পর সন্নিহিত অবস্থান ও সম্পৃক্ততা
এমন এক ধরণের গোপন যাদুর জন্ম দেয়
যা প্রেম বা আসক্তির চেয়ে অনেক উপরে
ঠোঁটের সাথে মিলুক ঠোঁট  নির্বাক প্রকোপে
এবং ভালোবাসার বিস্ফুরণে খান খান হোক হৃদয়

এবং বন্ধুতা - সে এক নির্জীব কথকতা
বহু বর্ষের স্বর্গীয় আনন্দ -
হৃদয় যখন মুক্ত
এবং নেতিয়ে পড়া পার্থিব পান্ডুর যখন
চেতনার বাইরে

যারা জগতের এই প্রান্তে আসার জন্য হন্যে
তারা অপ্রকৃতিস্থ পাগল
আর যারা ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে
তাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত

এখন কি তুমি বুঝতে পারো
তোমার করতলের স্পর্শে আন্দোলিত হয় না আমার হৃদয়

এমন কিছু কথা আছে (There are the Words ...)
এমন কিছু কথা আছে যা দু'বার বলা যায় না,
যে উচ্চারণ করে প্রথম সে ই শুষে তার সমুদয় স্বত্বা
শুধু দু'টো জিনিসেরই অন্ত নেই -
আকাশের নীলাভতা ও ঈশ্বরের অনন্ত কৃপা

আমি জানি না তুমি মৃত না এখনো বেঁচে আছো (I Don't Know If You're Aive or Dead)
আমি জানি না তুমি মৃত না এখনো বেঁচে আছো
তোমাকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে এই পৃথিবীতে
অথবা তখনি যখন সূর্য নিভে আসে
তুমি কি আসবে আমার ভারাক্রান্ত ও সমাহিত চিন্তনে ?

দৈনন্দিন প্রার্থনা গান
রাতের নির্ঘুম তাপ
কবিতার শুভ্র ঝাঁক
এবং আমার চক্ষু হতে নির্গত
নীল অগ্নি - এ সবই তোমার

এমন প্রচন্ড ভাবে কারো প্রতীক্ষা করি নি কোনো দিন
এমন যন্ত্রনা-বিদ্ধ কেউ করেনি কোনো কোনো দিন

যে আমাকে দুঃখ দেওয়ার জন্যেই হয়েছিলো  বিশ্বাস হন্তারক
আর ভালোবেসে কপোল ছুঁয়েও যে ভুলেছে অবশেষে
না - তুমি ওদের মতোও নয়

স্বপ্নে (In Dream)
দীর্ঘ্য ও অন্ধকার বিরহ
দুজনেই সমান অংশীদার
কান্না কেন ? বরং হাতে হাত রাখো
প্রতিজ্ঞা করো - আবার ফিরে আসবে

আমরা দু'জন দুই অচল পর্বত
অচল ও অ-সন্নিহিত
বরং মধ্যরাতে তারাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে
কিছু কিছু শব্দ পাঠাও
বাতাসে

একাকিত্ব (Solitude)
আমার প্রতি এতো পাথর নিক্ষিপ্ত হয়েছে যে নিক্ষিপ্ত প্রস্থর খন্ডে এখন আর ভয় নেই
আর আমার নিচু জমিতে গড়ে উঠেছে এক শক্তিমান স্তম্ভ - উঁচু থেকে আরো উঁচু
ধন্যবাদ পাথর ছুড়ে-মারা সেই নির্মাণ শ্রমিকদের -দুঃখ যেন ওদের স্পর্শ না করে

প্রদোষের নরম সূর্য্য সকলের আগে আগেই উঠে আসবে আমার চোখে
সূর্য্যের শেষ আনন্দিত রেশমী রশ্মিগুলো খেলা করবে আমারি আঙিনায়
আর আমার ঘরের খড়খড়ি দিয়ে বয়ে যাবে উত্তুরে হাওয়া
আর আমার হাতের থেকে শস্যের দানা খাবে একটি দোয়েল

আর আমার অসমাপ্ত খাতা সমাপ্তি পাবে
কাব্য-দেবীর হরিৎ আঙুলের অলৌকিক
ও কোমল ছোঁয়ায়

রেকুইয়াম (Requiem)

প্রবাসী আকাশের নিচে নয়
বিদেশী কোনো ডানার নিরাপদ ছায়ায় নয়
এই সব ভাগাভাগি করে নেবো আমার নিজের মানুষের সাথে
সেই খানে - যেখানে দুঃখ ও দুর্ভাগ্য পরিত্যাগ করেছে আমাদের
(১৯৬১)

ভূমিকার পরিবর্তে (Instead of a Preface)
ইয়াজহব সন্ত্রাসের সেই ভয়ঙ্করী কয়েকটি বছরের কথা। লেনিনগ্রাদের বন্দিশালায় আমি। দীর্ঘ্য সতেরো মাস। একদিন কেউ একজন কোনো ভাবে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।বাইরে। মনে পড়ে এক মহিলা ঠিক আমার পিছনে। ঠান্ডা হাওয়ায় নীল হয়ে জমে আছে তার ঠোঁট। অবশ্যই ও আমাকে চিনে না। অথবা কস্মিন কালেও শুনেনি আমার নাম। হঠাৎ শৈত্য-জরা ঝেড়ে ফেলে সে বললো। ফিসফিসিয়ে। কানে কানে।
: কেউ কি কখনো বর্ণনা করতে পারবে এর রূপ?
: হা, আমি পারবো
শুনে একধরণের হাসির ছররা ঝলকে গেলো ওর মুখের জমিনে - যা কিছুক্ষন আগেও ছিলো শুধুই একখানা মুখ।
(এপ্রিলের প্রথম দিন, ১৯৫৭, লেনিনগ্রাদ)

সমর্পন (Dedication)
এই অনন্ত শোকের পদপ্রান্তে আনত পর্বত
মহানদ ভুলেছে তার ক্ষিপ্র প্রবাহ
কিন্তু বন্দীশালার কপাট রয়ে যায়
আগল-বন্ধ ও অচল

বন্দী কোঠরির জানলা রুদ্ধ
কষ্ট মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি
কারো জন্য নরম হাওয়া বয়ে যায়
প্রশান্ত সূর্যাস্ত ছড়ায় উষ্ণতা;
আমরা এসবের কিছুই জানি না
আমরা সর্বত্র - আমরা সেই এক ই
আমরা শুনছি ঘৃন্যরহ সেই চাবির
কিচকিচ শব্দ ও তার ঘূর্ণন
এবং কুঁচকাওয়াজ-রত সেনাদের
বুটের ভারী আওয়াজ

ভোরের উপাসনার জন্য নয় -
প্রতি ভোরে আমরা রাজধানীর জনাকীর্ন পথে
আমরা বীজ বুনি
আমাদের দেখা হয়; নির্জীব, মৃত; সূর্য্য,
নিয়ত নিচে নেমে আসে; নেভা নদী আচ্ছন্ন কুজ্বটিকায়
দূরে থেকে আশা গেয়ে যায় তার চিরন্তনী গান

বিচারের রায় আসে
আসে অশ্রুর প্লাবন
তারপর সুমসাম - পরিপূর্ন একাকিত্ব
মনে হয় হৃদয়ের ধুঁকপুকানি যেন ফেঁটে পড়বে অসহ যন্ত্রনায়
অথবা ধাক্কা খেয়ে সে যেন সটান শুয়ে আছে - ভারাক্রান্ত
তবু সে কোনোমতে দাঁড়ায়, ইতস্তত হাটে - একা

তোমরা কোথায
ও আমার অনিচ্ছু বন্ধুগণ
আমার দু' বৎসরের শয়তান-সদৃশ বন্দীত্ব ?
সাইবেরিয়ার তুষার ঝড়ে অলৌকিক কি এমন দেখো তুমি ?
চাঁদের সান্নিধ্যে কি দেখো তুমি প্রজ্জ্বলিত কুহেলিকা ?

আমি তোমাদের সবাইকে পাঠালাম আমার
শুভেচ্ছা ও বিদায়ের বার্তা

ভূমিকা (Introduction/Prelude)
এ রখম ই ব্যাপারটা ঘটেছিলো -
ছাড়া পেয়ে আনন্দিত অর্ধ-মৃতরাই শুধু হেসেছিলো
সারা লেনিনগ্রাদ যেন একটা অসার মালার মতো
ঝুলেছিলো কয়েদখানার গলে - দুলছিলো অপ্রয়োজনীয় পুঁতির মতো
আর পুনঃপুনঃ অত্যাচারিত, যারা প্রায় বিনাশিত
তারা কুচকাওয়াজ করে বেরিয়ে এলো
তারা গান করলো - বিদায়ের শেষ ইঞ্জিন
ইঞ্জিনের বাঁশি ও নির্গত ধুম্রকুণ্ডলীর অন্ধকার ছায়া
আর মাথার উপরে মৃত্যুর মতো ঝুলে থাকা আকাশের তারা
আর আমাদের রুশ দেশ - উদ্ধত বুটের তলায় দলিত দেশ
নিরপরাধ অসহায়ের রক্তে রঞ্জিত সে দেশ
কয়েদখানার কালো গাড়ির কালো চাকা ও তার কালো গন্তব্য

I

তোমাকে তুলে নেয়া হলো ভোরের সহজতায়
আমি তোমাকে নিয়ে চললাম - যেন তুমি আমার মৃত সন্তান
ঘরের অর্ধ-ধূসর অন্ধকরে শিশুরা কেঁদেছিলো
এবং রশ্মি-হারা হয়েছিলো প্রিয়-হাতে আলোকবর্তিকা
তোমার ওষ্ঠে তখন বসবাস তীব্ৰ শীতল চুম্বন - প্রিয়তমের
তোমার ভুরুতে তার শীতল স্বেদ
ভুলে যেয়ো না - পুরাকালের কোনো এক বিদ্রোহীর স্ত্রীর মতোই
 লাল চত্বরে (রেড স্কয়ারে) দাঁড়িয়ে
বিলাপ করবো আমি
অনন্ত কাল
(১৯৩৫, শরৎ, মস্কো )

II

নিঃশব্দে বহে নদী ডন
আকাশে হলুদ চাঁদ চেয়ে আছে নিঃশব্দ রোদন
চাঁদের মাথায় টুপি - একদিকে একটু হেলানো
চাঁদ ঢুকে ঘরে
ঘরে ঢুকে দেখে
নারী এক রুগ্ণ অতিশয় - নিতান্ত একেলা
মৃত স্বামী
ছেলে তার অন্তরীণ কয়েদখানায়
আহা - বরং প্রার্থনা করো

III

না
এ আমি নই - যন্ত্রণাক্ত অন্য কেউ
এতো যন্ত্রনা সহ্য করার সামর্থ্য আমার নেই
একটা কালো কাপড়ে ঢেকে দেই এই সব
নিভে যাক দীপাবলি ...
শুধু থাক অমানিশা

IV

কৌতুকে ও প্রগলবতায় উদ্বেল সে মেয়েটি
আহা যদি দেখতে পেতে জার্ গ্রামের উল্লসিত সেই পাপিষ্টা মেয়েকে
কি রয়েছে জীবনের ভাঁড়ারে -
কিসের কৌটো হাতে দাঁড়ায়ে আছো
ক্রুশের নিচে তিন শততম অবস্থানে
নব বষের্র প্রথম বরফ গোলে যাচ্ছে তোমার অশ্রুর উষ্ণতায়
কয়েদখানার পপলার বৃক্ষ সমূহ দুলছে
নিশ্চুপ নৈঃশব্দ -
অপরাধহীন কত সংখ্যক আত্মার সমাপ্তি হচ্ছে এই
নিশ্চুপ নৈঃশব্দে ...
(১৯৩৮)

V

সতেরো মাস আমি কেঁদেছি
ডেকেছি নিজস্ব নিবাস
আপতিত হয়েছি জল্লাদের কৃষ্ণ পদতলে
তোমার জন্য
হে আমার পুত্র - আমার ভয়ঙ্করী বিবমিষা
সমগ্রই যেনা এক বিষম জট
আমি বুঝতে পারি না - কে মানুষ আর কে হায়ওয়ান
আর কখন তারা হত্যা করবে আমার পুত্রকে
এখন এখানে শুধু ধূলি মাখা ফুল
আগরদানির ব্যাদন ফাটল - হেথা হতে শূন্য বিনাশ
আর চেয়ে আছে সাক্ষাৎ আমার চোখে
এবং ধেয়ে আসছে ক্ষিপ্র বিনাশ
তারকার অগ্নিভ বিস্ফোরণে
(১৯৩৯)

VI

হালকা সপ্তাহগুলো অতিক্রান্ত হচ্ছে দ্রুততর
কিন্তু কি যে হচ্ছে বুঝতে পারছি না
পুত্র, কয়েদখানায় তোমার কুঠরী এখন কেমন
শ্বেত জ্বলজ্বলে রাত্রিগুলো চেয়ে থাকে স্থির
বাজ পক্ষীর চক্ষের মতোই নির্নিমেষ - তপ্ত ও জ্বলন্ত
পুত্র, সন্নিহিত মৃত্যুর ক্রোশ
(১৯৩৯, বসন্ত)

VII

ভার্ডিক্ট (রায়)
রায়ের শব্দগুলো ভারী পাথরের মতো নেমে এলো আমার বুকে
হৃদয়ের ধুকপুকানি ধুকে ধুকে এখনো কম্পমান
প্রস্তুত ছিলো আমার হৃদয় - নির্মোহ
সামলে তো নিতেই হবে

আজ আমার অনেক কাজ
আজ আমাকে হত্যা করতে হবে সমস্ত স্মৃতি
টগবগে আত্মাকে রূপান্তরিত করতে হবে প্রস্থরে
তারপর নিজেকে আবার শিখাতে হবে
বেঁচে থাকার কলাকৌশল ...

কিন্তু কি ভাবে
জানালার পরোক্ষে এক আনন্দমেলার মতো মর্মরিত হচ্ছে তাপিত গ্রীষ্ম
সে অনেক কাল, মনের মধ্যে কেবলি ঘুরপাক খাচ্ছে
এক উজ্জ্বল দুপুর আর বিরান বসতের ছবি
(জুন ২২, ১৯৩৯, গ্রীষ্ম, ফোনটাননি ডোম)

VIII

হে মৃত্যু (To death)
তোমার আগমন অবশ্যম্ভাবী - তবে এখনই কেন নয় ?
আমি তোমার প্রতীক্ষায়; জীবন ইদানিং অতিশয় দুঃসহ
নির্বাপিত প্রদীপ আর দ্বার অবারিত
তোমার জন্য, কতইনা সাধারণ অথচ চমৎকার
তোমার যেমন ইচ্ছা সে রূপেই তুমি আসো।
বিষাক্ত বাতাসের গোলা হয়ে আসো - প্রচন্ড বিস্ফোরণে
অস্ত্র হাতে দস্যুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে
বিষ ছড়াও টাইফয়েড বীজাণুৰ
অথবা তোমার নিজস্ব কোনো গল্প
(যে গল্প বিবমিষা-উদ্রেক এবং সকলেরই জ্ঞাত)
আমায় নিয়ে চলো নীল টুপি পরিহিত সেনাপতির সম্মুখে
এবং আমি দেখে নিই হাউস-ম্যানেজারের ভীত ও পান্ডুর মুখ
আমার আর মাথা ব্যাথা নেই - যা হবার হবে
ফুলে উঠেছে ইয়েনিজি যদি
ধ্রুব তারা আকাশে উজ্জ্বল
অতি প্রিয় সেই নীল আঁখির তারা
মুদে আসে - আবরিত হয় শেষ সন্ত্রাস
(অগাস্ট ১৯, ১৯৩৯, ফোনটাননি ডোম)

IX

পাগলামি তার ডানা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে আমার অর্ধেক আত্মা
সে আমায় পান করায় জ্বলন্ত সূরা ও নিয়ে যায় অন্ধ পাতালে

আর তখনি বুঝে নিলাম যে আমি নিমগ্ন মাতাল
আমার সমস্ত বিজয় তাকে  ফিরিয়ে দিতেই হবে

যতই না না করি
যতই ভিক্ষা মাগি
সে দেবে না কিছুই
একটিও কিছু না:

আমার পুত্রের সন্ত্রস্ত দৃষ্টি - না
পাথরে সমর্পিত দুঃখ - না
কয়েদখানায় দর্শনের স্মৃতি - না
অথবা দিন শেষের ঝঞ্জায় বিলীন সেই দিনগুলো

শীত কোমল স্পর্শের কোনো হাতের ছোঁয়া - না
লেবু বোনের বিস্রস্ত ছায়া - না
দূর অস্তের মৃদু কুঞ্জন - না
না
অন্তিম শান্তনার কোনো আশ্বস বাক্য ও না

X

ক্রুশবিদ্ধ (Crucifixation)
আর তুমি কেঁদো না মা
জাগি আমি কবরের হিমে
১.
দেবশিশুরা প্রশস্তি গাইলো এই মহতী সময়ের
আগুলের শিখা হয়ে গলে পড়লো আকাশ
ঈশ্বরকে সে জিজ্ঞেস করলো: "পিতঃ কি কারণে আমি পরিত্যক্ত ?"
আর মা কে বললো:
"আর কেঁদো না মা
আমার গোরের পাশে "
২.
ম্যাগদালেনা তীব্র বেদনায় কাতর ও ক্রন্দনরত
তার প্রিয় শিষ্য রূপান্তরিত প্রস্তরে
কিন্তু মাতা যেখানে একেলা দাঁড়িয়ে
সেখানে কারো চোখ পড়লো না
(১৯৪৩, তাসখন্দ)

Epilogue
১.
আমি জেনেছি থুবড়ে পড়ে মুখগুলো
আনত অক্ষি থেকে কি করে বেরিয়ে আসে সন্ত্রাস
দুর্গতি কি করে ঠাঁই পায় নিষ্ঠুরতার খাতার পাতায়
পান্ডুর কপোলে এঁকে রাখে কিউনিফর্ম হরফ
আমি জানি, কি করে কালো অথবা ছাই-সোনালী চুলের গুচ্ছ
সহসাই হয়ে যায় শুভ্র-তুষার
আমি শিখে গেছি কি করে বুঝে নিতে হয় -
আনত ওষ্ঠের ক্ষীয়মান হাসির আভা
অট্টহাসির লুকানো মজ্জায় আমি বুঝে নেই ভয়ের কাঁপন
আর তাই - আমি আমার নিজের জন্য আর প্রার্থনা করি না
তোমাদের সবার জন্য - যারা এখনো দাঁড়িয়ে আছো আমার চারপাশে
প্রচন্ডতম শৈত্য প্রবাহে এবং জুলাই-এর দাবদাহে
সম্পূর্ণ অন্ধ ও উল্লঙ্ঘনীয় এক লাল দেয়ালের নীচে
২.
যারা মৃত তাদের স্বর্ণের সময় এসেছে
তুমি আমার দৃষ্টিতে, শ্রুতিতে ও অনুভবে:
যে জানালা খুলার পূর্বে ইতস্তত করেছিল বহু কাল
যে বহু কাল জানতেই পারেনি কোনো আটপৌরে মাটির ছোঁয়া
তার পদতলে
সে সহসাই মাথা নেড়ে বললো:
"আমি এসেছি - যেনো আমারি স্বদেশ"
আমি তোমাদের সবাইকে নাম ধরে ডাকতে চাই
কিন্তু মুছে গেছে তালিকা - এমন কোথাও নেই যে খুঁজে পাবো
তাই
আড় কানে তোমার কথাগুলো দিয়ে বুনন করেছি প্রশস্ত এই আচ্ছাদন
তুলে রাখবো হৃদয়ে সর্বদা ও সর্বত্র
এমনকি নতুন দুঃখের আগমনেও ভুলে যাবো না তোমার যেকোনো সামান্য কথা
এমনকি ওরা যদি বন্ধ করে দেয় আমার তাড়িত কণ্ঠ
যে কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সহস্র লক্ষ জনতার মিলিত চিৎকার
যখন আমি আর থাকবো না - এ ভাবেই তারা আমাকে মনে রাখুক